বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নৌপথের নাব্য সঙ্কটসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুট। সড়ক পথের উন্নয়ন হলেও ঢাকা-বরিশাল নৌপথের ৫টি স্থানে নাব্য সঙ্কটের কোনো স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে ওই নৌরুট। ইতিমধ্যে বরিশাল নৌবন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে পলি জমে নাব্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয়ে লঞ্চ চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ঢাকা-বরিশাল নৌরুট চরম হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে। নৌপথ ব্যবহারকারীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চবাসীর সহজ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। রাত্রীকালীন নৌ-ভ্রমণ আরামদায়ক বিধায় নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের পদচারণাও বেশি। কিন্তু চলতি মৌসুমে নাব্য সঙ্কটের কারণে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঢাকা-বরিশাল নৌপথ। এমনকি নাব্য সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সহজ ও নিরাপদ নৌরুটগুলো। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে বরিশাল নদী বন্দর থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ৬টি পয়েন্ট নাব্য সঙ্কটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওসব পয়েন্ট হয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করতে গিয়ে কখনো কখনো দুর্ঘটনার শিকারও হতে হচ্ছে। নাব্য সঙ্কটের কারণে ইতিমধ্যে মিয়ারচর চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এক বছর ধরে ওই চ্যানেল হয়ে লঞ্চ চলাচল করতে পারছে না। সম্প্রতি মিয়ারচর চ্যানেলের প্রবেশমুখে একটি বাল্কহেড ডুবে যায়। সেটি উদ্ধার না করায় চ্যানেলটির বিভিন্ন পয়েন্টে পলি মাটি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। ওই কারণে বিকল্প চ্যানেল মেঘনার উলানীয়া-কালিগঞ্জ হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। তাতে লঞ্চগুলোকে গন্তব্যে পৌঁছতে দুই ঘণ্টারও সময় বেশি লাগছে। পাশাপাশি কমপক্ষে তিন ব্যারেল (৬শ’ লিটার) জ্বালানি তেল বেশি লাগে। বর্তমানে বিকল্প ওই চ্যানেলটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ একসময়ের উত্তাল ওই চ্যানেলটির প্রায় একশ’ মিটার এলাকাজুড়ে বর্তমানে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ দুই মিটার পানি থাকছে। অথচ যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো চলাচলের সময় তলদেশ অন্তত দুই মিটার পানিতে ডুবে থাকে। ওই কারণে ওই চ্যানেলে মাটি ঘেঁষে লঞ্চ চলাচল করতে হয়। তার মধ্যে ওই চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচরে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে থাকায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও রয়েছে। ওই চ্যানেলটিও বন্ধ হয়ে গেলে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের লঞ্চগুলোকে ভোলার ইলিশা হয়ে চলাচল করতে হবে। তাতে করে গন্তব্যে পৌঁছতে আরো এক ঘণ্টা সময় বেশি লাগবে। পাশাপাশি জ¦ালানি খরচও বেড়ে যাবে। সূত্র জানায়, ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বাউশিয়া-নলবুনিয়া চ্যানেলে আগে ৭ থেকে ৯ মিটার পর্যন্ত পানি থাকতো। বর্তমানে ওই চ্যানেলে জোয়ারের সময় ২ থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত পানি থাকছে। আর ভাটার সময় থাকে মাত্র এক মিটার পানি। যে কারণে ভাটার সময় বড় নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। বাকিটা পলি মাটি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। একই অবস্থা বরিশাল শহরের উপকণ্ঠ শায়েস্তাবাদের কীর্তনখোলা ও আড়িয়াল খাঁসহ তিন নদীর মোহনায়। সেখানে পলি মাটি জমে চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিন নদীর ওই মোহনায় ভাটার সময় চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই নৌযানগুলো আটকে যাচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, লঞ্চ মালিক এবং মাস্টাররা বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে নাব্য সঙ্কট সৃষ্টির জন্য বিআইডব্লিউটিএর অপরিকল্পিত ডেজিং ব্যবস্থাকেই দায়ি করছে। কারণ হিসাবে তারা জানান, মাত্র একবছর আগে বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগে নদীতে ড্রেজিং করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষ না হতেই যেসব চ্যানেলে ড্রেজিং করা হয়েছে তাতে আবার পলি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। কেননা ড্রেজিংয়ের বালু যেস্থান থেকে কাটা হচ্ছে তা আবার এক থেকে দেড়শ’ মিটার দূরেই ফেলা হয়েছে। ড্রেজিংয়ের বালু নদীতে না ফেলে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হলে বছর বছর এ সমস্যার সৃষ্টি হতো না। এদিকে নৌযান মালিকরা উন্নত সেবার মাধ্যমে যাত্রীদের ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সেজন্য নৌরুটের জৌলুস ধরে রাখতে বরিশালের লঞ্চ কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। যাত্রী ধরে রাখার ওই প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে আধুনিক লঞ্চ ও স্টিমার। বরিশালের ডকইয়ার্ডেই ওই লঞ্চগুলো নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে কীর্তনখোলা নদীর তীরে দেশীয় প্রযুক্তিতে চলছে সুন্দরবন-১৮ লঞ্চের নির্মাণ কাজ। ৩শ’ ফুট লম্বা এবং ৫২ ফুট চওড়া লঞ্চটিতে বিভিন্ন ধরনের কেবিন ছাড়াও যাত্রী সেবায় অনেক কিছুই সংযোজন করা হচ্ছে। তাছাড়া সুরভী-৭ লঞ্চেও নতুন ডেকোরেশনে লিফট লাগানো হয়েছে। কেবিন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই আধুনিকতা আনা হচ্ছে। লঞ্চগুলোতে চলন্ত সিঁড়ি, এটিএম বুথ, হেলিপ্যাড, সুইমিংপুলসহ অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করারও চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তাছাড়াও বরিশালের ৪টি ডকইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে সুন্দরবন কোম্পানির ৮টি, সুরভীর ৪টি, কীর্তনখোলা ও এ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির ২টি করে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল লঞ্চ। সেগুলোতে রয়েছে লিফট, আইসিইউ, ডাইনিং, শিশুদের খেলার জোন, রেস্টুরেন্ট, ব্রেস্টফিডিং রুম এবং ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। লঞ্চ চালনায়ও আনা হয়েছে ডিজিটাল যন্ত্র। নির্মাণাধীন লঞ্চগুলোতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়; যাত্রীদের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতে সেবার মান বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নৌপরিবহন (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, সবার আগে যাত্রী সেবার কথা চিন্তা করে কাজ করা হচ্ছে। সারাবছর যেন নির্বিঘ্নে লঞ্চ চলাচল করতে পারে, নাব্য সঙ্কটের কারণে যেন লঞ্চ চলাচল ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। পাশাপাশি নৌদুর্ঘটনা এড়াতে রাডারসহ নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। আশা করা যায়, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলেও বরিশালের আরাম প্রিয় মানুষ নৌযানেই বেশি যাত্রা করবে। নৌপথের নাব্যতা সঙ্কট প্রসঙ্গে বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা এবং বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার জানান, চলতি মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকে। এ কারণে কিছু কিছু পয়েন্টে পলি জমে নাব্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং ব্যবস্থা চালু করেছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে। যেসব পয়েন্টে পলি জমে নাব্য কমে গেছে সেসব পয়েন্টে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে ড্রেজিংয়ের বালু নদীতে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই। কেননা যে পরিমাণ বালু কাটা হয় তা স্থলে ফেলার মতো জায়গা নেই। ওই কারণে বিগত বছরেও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল কারোর নিম্নজমি থাকলে তা বিনামূল্যে ড্রেজিংয়ের বালু দিয়ে ভরাট করে দেয়া হবে। এবারও ওই একই ঘোষণা থাকবে। কিন্তু কেউ বালু না নিলে সেক্ষেত্রে নদীতে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তবে খুব শিগগিরই ঢাকা-বরিশাল নৌরুট নিরাপদ করে তুলতে চ্যানেলগুলোতে ড্রেজিং কার্যক্রমের মাধ্যমে নাব্য সঙ্কট দূর করা হবে।
Leave a Reply